২১৪দিনের যুদ্ধে ইসরায়েল গাজায় এখনো পর্যন্ত ১৪২জন সাংবাদিককে হত্যা করেছে। প্রতি ৩৬ ঘন্টায় প্রায় একজন সাংবাদিক দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে মারা গেছেন। সাংবাদিকদের হত্যার এই বিশাল সংখ্যা যুদ্ধটিকে আধুনিক ইতিহাসে সাংবাদিকদের জন্য সবচেয়ে মারাত্মক সংঘাতে পরিণত করেছে।
কিন্তু বিখ্যাত আল জাজিরা সাংবাদিক ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক শিরিন আবু আকলেহকে হত্যা করা হয় গাজা যুদ্ধ শুরুরও প্রায় দুই বছর আগে। তাই সংবাদকর্মীরা বলছেন, শিরিনের হত্যাকান্ড এই সত্যটি তুলে ধরে যে ইসরায়েল বর্তমান যুদ্ধের অনেক আগে থেকেই দায়মুক্তির সাথে সাংবাদিকদের হত্যা করছে। ২০২২সালের ১১মে অধিকৃত পশ্চিম তীরে রিপোর্ট করার সময় ইসরায়েলি বাহিনীর দ্বারা গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান শিরিন।
ওয়াশিংটন ডিসির আরব সেন্টারে প্যালেস্টাইন/ইসরায়েল প্রোগ্রামের প্রধান ইউসেফ মুনায়ের মনে করেন, হত্যাকাণ্ডে জবাবদিহিতার অভাব গাজায় সংঘটিত ব্যাপক ইসরায়েলি নির্যাতনের পথ প্রশস্ত করতে সাহায্য করেছে। আল জাজিরাকে মুনায়ের বলেন, “গাজায় রেকর্ড সংখ্যক সাংবাদিক হত্যার পরিপ্রেক্ষিতে ইসরায়েলকে আমরা যা করতে দেখেছি, তা শিরিনের জন্য জবাবদিহিতার অভাবের সাথে সরাসরি যুক্ত। আপনি যদি ক্যামেরার সামনে একজন আমেরিকান নাগরিককে হত্যা করতে পারেন, যিনি আরব বিশ্বের সর্বোচ্চ সাংবাদিকদের মধ্যে একজন ছিলেন এবং তারপর পালিয়ে যেতে পারেন, তাহলে এটি বাকিদের কাছে খুব স্পষ্ট একটি বার্তা পাঠায়।”
পশ্চিম তীরের উত্তর অংশের জেনিনে একটি ইসরায়েলি অভিযান কভার করার সময় যখন শিরিনকে গুলি করা হয়, তখন তিনি “প্রেস” শব্দ চিহ্নিত একটি নীল ভেস্ট পড়ে ছিলেন।
প্রাথমিকভাবে তৎকালীন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেট মিথ্যাভাবে ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে তাকে গুলি করার অভিযোগ এনেছিলেন। যদিও সেই অভিযোগ অন্যান্য স্বাধীন তদন্ত রিপোর্ট দ্বারা দ্রুত মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছিল।
কিভাবে মার্কিন সরকার দায়বদ্ধতা এড়ালো!
আবু আকলেহের উপর গুলি চালানোর পরপরই, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন জবাবদিহিতার আহ্বান জানিয়ে বলেছিল, “যারা শিরিনের হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী, তাদের আইনের পূর্ণ মাত্রায় বিচার করা উচিত।”
কিন্তু ওয়াশিংটন তার অবস্থান পরিবর্তন করে যখন ইসরায়েল স্বীকার করে তাদের সৈন্যরা শিরিনকে হত্যা করেছে। সেই সাথে ঘটনার কোনো তদন্ত করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে সেটিকে একটি দূর্ঘটনা বলে উড়িয়ে দিয়েছিল ইসরায়েল।
২০২২ সালের সেপ্টেম্বরের পর মার্কিন প্রশাসন অপরাধীদের বিচারের দাবি থেকে সরে আসে। ওয়াশিংটন এই ঘটনার একটি স্বাধীন তদন্তের আহবানও প্রত্যাখ্যান করে। তারা এই যুক্তি প্রদান করে, ইসরায়েলের কার্যকরী প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা মামলাটির তদন্ত করতে সক্ষম।
কিন্তু ফিলিস্তিনি অধিকার প্রবক্তারা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছেন, ইসরায়েল খুব কমই তার নিজের সৈন্যদের বিচার করে। তাদের তদন্তকে বিশ্বাস করা উচিত নয়।
মুনায়ের মনে করেন, বাইডেন প্রশাসনের এই পদক্ষেপ ইসরায়েলকে সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের পথ প্রশস্ত করার অলিখিত অনুমতি দিয়েছিল। এমনকি যখন আল জাজিরা শিরিন আবু আকলেহের মামলাটি তদন্তের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে অনুরোধ করেছিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যে আদালতের জড়িত হওয়ার বিরোধিতা করে। যুক্তরাষ্ট্র তখন তার অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করে বলে, এটি ইসরায়েলের নিজস্ব বিষয়। বাইডেন প্রশাসন জেরুজালেমে আবু আকলেহের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় ইসরায়েলি হামলার নিন্দা করতেও ব্যর্থ হয়েছিল, যেখানে সশস্ত্র অফিসাররা শিরিনের দেহ বহনকারীদের লাঠি দিয়ে পিটিয়েছিল।
এই ঘটনাকে ভুলে যাওয়া সম্ভব নয় উল্লেখ করে মুনায়ের বলেন, “এই ঘটনাকে আমরা ভুলতে যাচ্ছি না তার অন্যতম প্রধান কারণ, শিরিনের হত্যার জবাবদিহিতা অর্জনে ব্যর্থতার পরিণতি প্রতিদিন গাজায় প্রদর্শিত হচ্ছে।”
“আমরা এখনো ন্যায়বিচার পাইনি”
শিরিন আবু আকলেহের পরিবার বেশ কয়েকবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন ও কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করে বিষয়টি নিয়ে কথা বলার মাধ্যমে তার মৃত্যুর জবাবদিহিতার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে চাপ দিয়েছে।
ওয়াশিংটন ডিসিতে এই সপ্তাহে এক অনুষ্ঠানে নিহত সাংবাদিকের ভাগ্নি লিনা আবু আকলেহ বলেন, “গত দুই বছর মনে হচ্ছে খুব দ্রুত চলে গেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত দুই বছর পরেও আমরা এখনো ন্যায়বিচার পাইনি, এখনো কোনো জবাবদিহিতা নেই।”.
লিনা অভিযোগ তোলেন, মার্কিন প্রশাসন একজন আমেরিকান নাগরিককে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে, যিনি একজন মহিলা সাংবাদিক ছিলেন।
২০২২ সালের শেষের দিকে, বেশ কয়েকটি সংবাদ প্রতিবেদনে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছিল এফবিআই এই ঘটনার জন্য নিজস্ব তদন্ত শুরু করেছে। কিন্তু বিচার বিভাগ এই ধরনের তদন্তের কথা অস্বীকার করে।
শুক্রবার কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট (সিপিজে) স্থগিত তদন্তের বিষয়ে এফবিআই থেকে স্বচ্ছতার আহবান জানিয়েছে।
সিপিজে প্রোগ্রাম ডিরেক্টর কার্লোস মার্টিনেজ দে লা সেরনা এক বিবৃতিতে বলেছেন, “সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডে ইসরায়েলের দীর্ঘদিনের দায়মুক্তি ভাঙার সময় এসেছে, যা ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধে বেড়েছে। এফবিআইকে তার তদন্তের সমাপ্তির জন্য একটি সময়রেখা প্রকাশ করতে হবে। ইসরাইলকে অবশ্যই এফবিআই তদন্ত এবং ভবিষ্যতের আইসিসি তদন্তে সহযোগিতা করতে হবে।”
গত বছর, আবু আকলেহের হত্যার প্রথম বার্ষিকীতে, সিপিজে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, কিভাবে ইসরায়েলি বাহিনী দুই দশক আগে ২০ জন সাংবাদিককে হত্যা করেছিল। এটি একটি বিশেষ প্যাটার্ন। সেই প্রতিবেদনে বলা হয় এই মৃত্যুগুলোর জন্য কাউকে কখনও অভিযুক্ত বা দায়ী করা হয়নি।
দায়মুক্তির সেই প্যাটার্ন গাজার যুদ্ধের সাথে তীব্র হয়েছে বলে মনে করা হয়। তবে আইনজীবীরা বলছেন, তারা শিরিনের ন্যায়বিচারের জন্য চাপ অব্যাহত রাখবেন। বিশেষ করে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ইসরায়েল আইন লঙ্ঘনের সংখ্যা যেভাবে দিন দিন বৃদ্ধির পাচ্ছে সেটি বন্ধ করা জরুরি।