গাজায় ইসরায়েল গণহত্যা চালিয়েছে বলে নিরাপত্তা পরিষদে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদক, ফ্রান্সেসকা আলবানিজ। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে তার প্রতিবেদনে লিখেছেন, “গাজায় ফিলিস্তিনিদের উপর ইসরায়েলের গণহত্যা একটি ক্রমবর্ধমান পর্যায় ধরে চলছে।”
প্রতিবেদনে বলা হয়, “সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে এই প্রক্রিয়া ফিলিস্তিনি জনগণকে একটি গোষ্ঠী হিসাবে শ্বাসরোধ করেছে – জনসংখ্যাগতভাবে, সাংস্কৃতিকভাবে, অর্থনৈতিকভাবে এবং রাজনৈতিকভাবে। এই গণহত্যা এই এলাকার মানুষকে বাস্তুচ্যুত করতে বাধ্য করেছে। ইসরায়েল গাজার ভূমি ও সম্পদ দখল ও নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে।” দ্রুতই এই ধ্বংসলীলা চিরতরে বন্ধ করার জন্য প্রতিবেদনে জোর দিয়েছেন ফ্রান্সেসকা।
জাতিসংঘ ফ্রান্সেসকার প্রতিবেদনে গাজায় গণহত্যার যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য তথ্যপ্রমাণ পেয়েছে। যেগুলোর মধ্যে রয়েছে, একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর সদস্যদের হত্যা করা, শারীরিক ও মানসিকভাবে সেই গোষ্ঠীর সদস্যদের জীবনকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া, ইচ্ছাকৃতভাবে শারীরিক ক্ষতিসাধন।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, “ইসরায়েল “সন্ত্রাসী” বা “সন্ত্রাসী সমর্থক”দের নামে সম্পূর্ণ একটি জাতিকে লক্ষ্যে পরিণত করেছে, যেখানে প্রতিনয়ত সরাসরি হত্যা বা “কোলেটারাল ড্যামেজ”এ আক্রান্ত হচ্ছে সবাই।”
এছাড়াও জাতিসংঘের প্রতিবেদক ফ্রান্সেস্কা আলবানিজ এই প্রতিবেদনে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর কাছে সুপারিশ করেন, সদস্য দেশগুলির উচিত “অবিলম্বে ইসরায়েলের উপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা।” পাশাপাশি অন্যান্য অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পদক্ষেপগুলি কার্যকর করা যেটি দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয়।
ফ্রান্সেসকা আরো সুপারিশ করেছেন, দক্ষিণ আফ্রিকা ইসরায়েলের মামলাটি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে নিয়ে যাওয়া উচিত। কারণ ইসরায়েল গাজায় গণহত্যামূলক কর্মকাণ্ডের বিষয়ে আন্তর্জাতিক আদালতের (আইসিজে) অন্তর্বর্তী রায় উপেক্ষা করছে। এছাড়াও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের জন্য একটি স্বাধীন ও স্বচ্ছ তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন আলবানেজ। যার ফলে “ইসরায়েল ও গাজা গণহত্যায় জড়িত রাষ্ট্রগুলি” তাদের ভুল স্বীকার করবে, পুনরাবৃত্তি না করার প্রতিশ্রুতি দেবে এবং তা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এছাড়াও গাজা পুনর্গঠনের সম্পূর্ণ খরচ সহ ক্ষতিপূরণ বহন করবে ইসরায়েল ও সেই দেশগুলি।
একইসময়ে জেনেভাভিত্তিক সংস্থা ইউরো-মেড হিউম্যান রাইটস মনিটর এক বিবৃতিতে বলেছে, আন্তর্জাতিক আদালতের নির্দেশ ভঙ্গ করে ইসরায়েল গাজায় গণহত্যা চালিয়েছে। দুই মাস পূর্বে আন্তর্জাতিক আদালত এক রায়ে গাজা উপত্যকায় গণহত্যামূলক কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে ইসরাইলকে ছয়টি ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছিল। ইসরাইল সেই সবগুলো নির্দেশ লঙ্ঘন অব্যাহত রেখেছে।
সংস্থাটি বলছে, “ফিলিস্তিনি জনগণকে ধ্বংস করার অভিপ্রায়ে বিভিন্ন উপায়ে গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। যারমধ্যে রয়েছে সরাসরি গুলি, কোয়াডকপ্টার এবং ইসরায়েলি ট্যাঙ্কের শেল দিয়ে মানবিক সহায়তা ট্রাকের চারপাশে বেসামরিক জনসমাবেশকে লক্ষ্য করে হামলা করা। গত কয়েক সপ্তাহে ফিলিস্তিনি বেসামরিকদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর বেআইনি হত্যা এবং মৃত্যুদন্ডের ঘটনাও রয়েছে এর মধ্যে।”
এদিকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে গাজায় যুদ্ধবিরতির আহ্ববান জানিয়ে একটি প্রস্তাব পাশ হয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী রাষ্ট্রগুলোর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তৈরি হয়েছে এই প্রস্তাব। পরিষদের ১৪টি দেশ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়। প্রস্তাবটিতে কোনোধরনের ভেটো বা ভোট প্রদান থেকে বিরত ছিল যুক্তরাষ্ট্র।
প্রস্তাবে গাজায় ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনি গ্রুপ হামাসের মধ্যে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি এবং সমস্ত বন্দীদের অবিলম্বে এবং নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করা হয়েছে। গাজা প্রস্তাবে আরও দাবি করা হয়েছে, রমজান মাসের জন্য অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি করতে হবে, যা একটি দীর্ঘস্থায়ী, টেকসই যুদ্ধবিরতির দিকে পরিচালিত করবে। এছাড়াও গাজায় চিকিৎসা ও অন্যান্য মানবিক চাহিদা পূরণের জন্য মানবিক সহায়তা প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা এবং ইসরায়েল ও হামাস তাদের কাছে আটককৃত সকল বন্দীর ব্যাপারে আন্তর্জাতিক আইনের বাধ্যবাধকতা মেনে চলার আহ্ববান করা হয়েছে।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার ৬মাস পরে প্রথমবারের মতো গাজা সম্পর্কিত কোনো প্রস্তাব পাশ হলো জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে। ফিলিস্তিনের হামাস, ফাতাহসহ বিশ্বের অনেক দেশ এই প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছে। এছাড়াও তারা আহ্ববান জানিয়েছে যত দ্রুত সম্ভব, নিরাপত্তা পরিষদ যেন গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকরে প্রচেষ্টা চালায়।
নিরাপত্তা পরিষদে গাজা প্রস্তাব পাশের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েলের উগ্র ডানপন্থী নেতা জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রী ইতামার বেন-গভির জাতিসংঘকে একটি “বর্জ্যভূমি” বলে আখ্যায়িত করেছেন। এছাড়াও মার্কিন ও ইসরায়েলি গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে যে নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবে মার্কিন ভোটে বিরত থাকার কারণে নেতানিয়াহু তার পরিকল্পিত রাফাহ আক্রমণের বিষয়ে হোয়াইট হাউসে আলোচনার জন্য একটি ইসরায়েলি প্রতিনিধিদলের সফর বাতিল করেছেন।
মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার ওয়াশিংটনে একটি ব্রিফিংয়ের সময় সাংবাদিকদের বলেছেন, “এটি “আশ্চর্যজনক এবং দুর্ভাগ্যজনক” যে ইসরায়েল এবং হামাসের মধ্যে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির দাবিতে জাতিসংঘের ভোট থেকে যুক্তরাষ্ট্র বিরত থাকার পরে একটি ইসরায়েলি প্রতিনিধি এই সপ্তাহে নির্ধারিত আলোচনায় আসছে না।” মিলার আরো যোগ করেন, “গাজার ২.৩ মিলিয়ন জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকের জন্য শেষ আশ্রয়স্থল রাফাতে স্থল আক্রমণ ইসরায়েলের জন্য একটি ভুল সিদ্ধান্ত হবে এবং এটি ইসরায়লের নিরাপত্তাকে আরো দুর্বল করবে।”
Source: https://aje.io/